Saturday, March 12, 2016

ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাকি রাজাকার? ঃ সিরাজী এম আর মোস্তাক

সিরাজী এম আর মোস্তাকঃ বলা হয়ে থাকে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে এবং প্রায় দুই লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। এ শহীদ ও আত্মত্যাগীগণ মুক্তিযোদ্ধা নাকি রাজাকার, স্বাধীনতার পয়তাল্লিশ বছরেও তা নিস্পন্ন হয়নি। মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে যারা প্রাণ হারান, তারা একইসাথে যোদ্ধা এবং শহীদ। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের পুরো দেশটাই ছিল একটি যুদ্ধক্ষেত্র, সুতরাং সকল শহীদ ও আত্মত্যাগীগণই ছিলেন এক একজন যোদ্ধা। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র প্রায় দুই লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, শহীদগণ হয়তোবা রাজাকারই ছিলেন।
১৯৭১ সালে এদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিই দু’দলে বিভক্ত ছিলেন। তাহলো- পাকিস্তানি রাজাকার এবং ভারতীয় রাজাকার। এদের মধ্যে যারা পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন, তারা যেমন শহীদ; ঠিক তেমনিভাবে যারা মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন, তারাও তাদের দলে শহীদ স্বীকৃতি পেয়েছেন। এসব মিলে মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যাটি যথার্থ ও যুক্তিযুক্তই ছিল। তাই বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুষ্পষ্টভাবে শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ ও সম্ভ্রমহারা মা-বোনের সংখ্যা দুই লাখ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এছাড়া বিশেষ ভূমিকার জন্য তিনি মাত্র সাতজন শহীদকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব দেন। এটাই শহীদের চুড়ান্ত সংখ্যা। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এবং ত্রিশ লাখ সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা। এতে রাজাকার শহীদগণও মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে এ সত্যটিই তুলে ধরেন। যুদ্ধনীতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু মাত্র ৬৭৬ জন বিশিষ্ট যোদ্ধাকে খেতাব প্রদান করেন। তাদের ০৭ জন শহীদ বীরশ্রেষ্ট, যোদ্ধাদের ৬৮ জন বীর উত্তম, ১৭৬ জন বীর বিক্রম ও ৪২৫ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেন। এছাড়া দেশের সকল জনতা, শহীদ, বন্দী ও আত্মত্যাগী নির্বিশেষে সবাইকে ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি দেন। যুদ্ধকালে বন্দী হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজেও একজন ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সমর্থন ও খুনী পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিচারের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু কথিত দালাল আইনে বিচারও শুরু করেন। সিমলা চুক্তির ফলে বিশেষ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায়, বঙ্গবন্ধু নিজেই উক্ত বিচার প্রক্রিয়া বাতিল করেন এবং অভিযুক্ত দালালদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি প্রদান করেন। তার এ মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমগ্র জাতি তাকে ‘বাঙ্গালি জাতির জনক’ হিসেবে চির শ্রদ্ধার্হ করেন।
পরবর্তীতে অসাধু রাজনীতিবিদগণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা মাত্র দুই লাখ তথাকথিত ভারতীয় রাজাকারদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের আত্মত্যাগ অস্বীকার করে মাত্র ৪১ নারীকে বাীরাঙ্গনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এ তালিকাভুক্তদেরকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসুবিধা প্রদানের নামে তারা দেশে অন্যায় বৈষম্য সুষ্টি করেছে। এভাবে তারা খোদ বঙ্গবন্ধুকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেছে। তারা যে দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ বীরাঙ্গনার তালিকা করেছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। ঠিক এভাবে তারা ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেছে। যে হাজার হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাক হানাদারমুক্ত করেছেন, তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রেখেছে। লাখ লাখ বন্দী ও শরণার্থী বাঙ্গালির আত্মত্যাগ অস্বীকার করেছে। তারা শুধু দুই লাখ পরিবারকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগী ঘোষণা করেছে, যেন তারাই এককভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। তারা ভিন্ন সকলেই রাজাকার। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ শহীদ, বন্দী, শরণার্থী, সম্ভ্রমহারা এবং যুদ্ধকালে দেশে অবস্থানকারী কোটি কোটি বাঙ্গালি সকলেই রাজাকার।
এতে প্রতিয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে প্রচলিত মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কখনোই সঠিক নয়। অর্থাৎ বর্তমানে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি সম্পুর্ণ অবৈধ ও প্রহসনের নামান্তর। পৃথিবীর কোনো যুদ্ধে বাংলাদেশের মতো শহীদের চেয়ে যোদ্ধা সংখ্যা কখনোই কম দেখা যায়নি। যে কোনো যুদ্ধে শহীদের চেয়ে যোদ্ধা সংখ্যা অবশ্যই বেশী থাকে। কারণ যোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ, আহত, বন্দী ও গাজী সবই থাকে। যোদ্ধাদের সকলেই শহীদ হয়না। তাদের একাংশ বা কিয়দাংশ মাত্র শহীদ হয়। তাই সকল শহীদই এক একজন যোদ্ধা বিশেষ। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তাই হয়েছিল। সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধার মধ্য থেকে ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছিল।
সুতরাং যতদিন বাংলাদেশে প্রচলিত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার অবৈধ কোটানীতি চালু থাকবে, ততোদিন বঙ্গবন্ধুসহ ত্রিশ লাখ শহীদ ও ৭১’এর সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাগণ রাজাকার হিসেবে বিবেচিত হবেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস রচিত হতে থাকবে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হবে। দেশের আপামর জনতা এ সমস্ত মিথ্যা ইতিহাসের আবর্তে শতধা বিভক্ত হবে। যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
এজন্য এখনই উচিত, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংশোধন করা। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করা। তার ঘোষণা অনুসারে, ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকেই মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া। ত্রিশ লাখ শহীদসহ সকল বন্দী ও শরণার্থীদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া। বর্তমানে প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি বাতিল করা। দেশের ষোলকোটি নাগরিক সবাইকে ‘৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা।
অতএব, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিকের কাছে আমার আবেগাপ্লুত জিজ্ঞাসা, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাকি রাজাকার?
এ্যাডভোকেট, ঢাকা। সৎসড়ংঃধশ৭৮৬@মসধরষ.পড়স.

No comments:

Post a Comment