Friday, September 2, 2016

কুয়েতে বিনা বেতনে চাকুরী,দেশ এগুচ্ছে ঠিকই; কিন্তু প্রবাসীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি

বাংলাদেশী শ্রমিকরা বিনা বেতনে কাজ করে। এ কথাটা আপনার বিশ্বাস নাও হতে পারে। বিশ্বাস আপনার হোক বা না হোক, এটাই বাস্তব, এটাই সত্য। এসব বাংলাদেশী শ্রমিকদের একমাত্র আয়ের উৎস ভিক্ষা, দান, ছদকা ইত্যাদি। অবশ্য এটাকে বখশিস নামেই মুখে মুখে উচ্চারণ হয়। কুয়েতের যে সুপার মার্কেট গুলি আছে, যেটাকে স্থানীয় ভাষায় “জামইয়্যাহ” বলা হয়। এই মার্কেটগুলিতে ক্যাশিয়ারের পিছনে যারা ট্রলি বহন করে তারা কি বেতন পায়? না তারা উল্টো কোম্পানীকে বেতন দেয়? এই সুপার মার্কেটগুলিতে বাংলাদেশী লেবারদের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। এরপর কুয়েত এয়ারপোর্টে যারা ট্রলি বহন করে, তাদেরও ঐ একই অবস্থা। সেখানের সংখ্যাটাও কম নয় কুয়েতের সুক আল জুম্মা নামে পরিচিত মার্কেট। যেটাকে ফ্রাইডে মার্কেট বলা হয়। এই ফ্রাইডে মার্কেটে যারা ট্রলি বহন করে তাদেরও ঠিক ঐ একই অবস্থা বেতন নাই।
কুয়েতের ছাবরা বা হোল সেল মার্কেট, এই ভ্যাজিটেবল বা হোল সেলে মার্কেটে যারা ট্রলি বহন করে, তাদের সংখ্যাও কম নয়। তারাও ঐ জামইয়্যার মতন বেতন পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো বেতন দিতে হয়। দান, ছদকা, বখশিসের মাধ্যমে যা পায় তার থেকে একটা অংশ প্রতিদিন কোম্পানীর ফান্ডে জমা দিতে হয়। এছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে যেমন ফিস মার্কেট। পোর্ট এলাকা। এখানে যারা কাজ করেন তাদের ও ঐ একই অবস্থা। মার্কেট এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছাড়া আরও যে সব এলাকা আছে যেমন সুপার মার্কেটের সামনে বা জামইয়্যার সামনে, (গাড়ী পার্কিং এরিয়া) কুয়েতীদের আবাসিক এলাকা, ট্রাফিক সিগন্যালের মোড়, স্কুল ও হাসপাতালের সামনে, বিনোদন মূলক পার্কের সামনে যারা ঝাড়– মারেন বা ক্লিনারের কাজ করেন। এরা প্রতি মাসে কোম্পানীর নিকট থেকে একটা বেতন পান। তবে সেই বেতনের একটা অংশ বা বেতনের অর্ধেক বা তারও বেশী তার উপর ওয়ালাদের সন্তুষ্টির জন্য উপরে পাঠাতে হয়। এরপর তার মাসিক খরচ ও অন্যান্য খরচ এবং দেশের বাড়ীতে টাকা পাঠানো। যা আমাদের সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। সেটা নির্ভর করতে হয় দান, ছদকা, বখশিস ইত্যাদির উপর। ক্লিনার বা লেবাররা তাদের উপর ওয়ালাদের সন্তুষ্ঠির জন্য হাদিয়া পাঠাতে যদি হেরফের হয়, তাহলে তার পরিণতি কাজের স্থান বদল। যেখানে কাজ করছিল সেখান থেকে বদলী করে অন্যত্র দূরে কোথাও।
এরপর আসুন কুয়েতের মসজিদগুলিতে যারা ফরাশ বা ক্লিনার হিসাবে কাজ করছেন তাদের কথায়; মসজিদগুলিতে ফরাশের কাজ পাওয়ার জন্য মোটা অংকের হাদিয়া উপর ওয়ালাদের দিতে হয়। ঐ হাদিয়ার টাকা আয় করতে একজন ফরাশের কখনও এক বৎসর বা তারও বেশী সময় লাগে এই সময়টা বিনা বেতনেই চাকুরী করার মতন।
কুয়েতের বাসা বাড়ীতে যারা চাকুরী করে, তাদের কথা ধরুন। তারাও কোন না কোনভাবে হারাতে হয় তাদের একাধিক মাসের বেতন। কখনও দেখা যায় একজন ড্রাইভার দু’বছর চাকুরী করার পর যখন তার মালিককে বলে আমি দেশে যাবো। তখন মালিক হয়তো তাকে জানিয়ে দিচ্ছে না তোকে দেশে যেতে দেওয়া হবে না। তুই অন্য কোথাও কাজ দেখ। তোকে রিলিজ দেব। আর রিলিজের জন্য ২০০ দিনার দিতে হবে। যদি রিলিজের টাকা দিতে না পারিস তাহলে তোর বেতনের টাকা দিয়ে তুই দেশে যাবি। আমি তোর আকামা কেটে দেব। এই আকামা বা রেসিডেন্সী পারমিট কাটার ভয়ে দেশে ফেলে আসা স্ত্রী, সন্তানদের কথা চিন্তা করে বাসায় চাকুরী করেন এমন অনেকে তার মালিকের হাতে টাকা তুলে দেয়।
অথবা কয়েক মাসের বেতনে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র কাজে যোগ দেয়। ছুটিতে দেশে গিয়ে স্ত্রী সন্তান, মাকে দেখার আর সুযোগ হয়নি। রাতের আঁধারে চোখের পানিতে বুক ভাসায়।
বিভিন্ন বড় কোম্পানীতে আর মিনিষ্ট্রিতে ড্রাইভার সাপ্লাই দেয় এমন কিছু গাড়ী ভাড়ার কোম্পানী আছে। যারা ড্রাইভারসহ গাড়ী দেয়। এসব ভাড়া গাড়ীর কোম্পানীতে যারা ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন তাদের সাথে কি কখনও আলাপ করে দেখেছেন। তারা কি পায় কি দেয়। ৪০ দিনার থাকা খাওয়া নিজের। বলেন তো কিভাবে চলবে। ৭/৮ লাখ টাকা খরচ করে এসেছে। ঐ টাকাই বা কিভাবে উঠাবে। উপায় না দেখে কোম্পানীর চাপিয়ে দেয়া শর্তটি মেনে নিতে হয়। কোম্পানীর গাড়ী প্রতিদিন কোম্পানীর গ্যারেজে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রাখতে পারবে। গাড়ীর তেল, মবিল থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ সব নিজেই বহন করতে হবে। নিজের থাকা খাওয়ার খরচ, গাড়ীর যাবতীয় খরচ ইত্যাদি সব বহন করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নামতে হয় ঝুঁকির পথে অবৈধ যাত্রী বহনে। ৩/৪ বছর পর দেশে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও তা সহজে হয়ে উঠেনা। দেশে যেতে বিমানে উঠার জন্য ছুটি পাওয়া ও পাসপোর্ট হাতে পেতে উপর ওয়ালাদের সন্তুষ্টির জন্য দিতে দিতে পকেটের অবস্থা শূন্যে পৌঁছে। অনেক সময় খালি হাতে দেশের পথে যাত্র করতে হয়। এখন আপনিই বলুন ৩/৪ বছর চাকুরী করে কি পেল সে।
বিবরণ কাহিনী আর বেশী টানলাম না। আরও আছে হিসাব করলে দেখা যাবে এই কুয়েতে যে পরিমাণ বাংলাদেশী শ্রমিক আছে, তার মধ্যে অর্ধেকের মত শ্রমিক বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছে। এরা দান, খয়রাত, ছদকা, আর বখশিসের আয়ের দ্বারা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আমাদের সরকার আর আমাদের বিদেশের কুটনৈতিক মিশনগুলির মাননীয় কর্মকর্তাবৃন্দ, প্রবাসের এসব শ্রমিকদের হাল অবস্থার তথ্য জানা থাকারই কথা। তবুও না জানারই ভান না দেখারই ভান। এভাবে চলছে। সামনের দিনগুলোও হয়তো এভাবে যাবে।
প্রবাসী শ্রমিকরা দান, ভিক্ষা, ছদকার মাধ্যমে দিনার উপার্জন করবে। সেই দিনার (টাকা) দেশে পাঠিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ফান্ড বাড়াবে। আর তখন আমাদের মন্ত্রীরা গর্ব আর অহংকারের সাথে বলবেন এ বছর প্রবাসী শ্রমিকরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সাফল্য অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে। এই অবস্থা আর কত দিন চলবে….?

ipcblogger.net থেকে সংগৃহীত 

No comments:

Post a Comment