Sunday, September 4, 2016

রোহিঙ্গাদের নাম ব্যবহার করে বিত্তশালী মীর কাসেম

চট্টগ্রাম: মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জনগণকে বিচ্ছিন্নতাবাদে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীন আরাকান রাজ্য গঠনের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে শত, শত কোটি ডলার দেশে এনেছেন মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী। রোহিঙ্গাদের জন্য আনা সেই বিপুল অর্থে বিত্তশালী হয়েছেন মীর কাসেম, অর্থ-বিত্তে শক্তিশালী করেছেন জামায়াতকেও।
আবার সেই বিপুল অর্থ থেকে কিছু অংশ ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদের নামে রোহিঙ্গা তরুণদের হাতে তুলে দিয়েছে অস্ত্র, দিয়েছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ। তবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা অর্থের বড় অংশই নিজের তহবিলে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্বাধীন দেশে বিপুল বিত্তবৈভবের অধিকারী হয়েছিলেন এই আলবদর কমান্ডার।
৩ সেপ্টেম্বর রাতে কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে একাত্তরের জল্লাদ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীর জীবনাবসান হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রামের কক্সবাজার এবং রাঙামাটি-বান্দরবানের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মীর কাসেম আলীর জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ডের কথা এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।
পুলিশ সূত্রমতে, কক্সবাজার-বান্দরবান এবং রাঙামাটিতে মধ্যপ্রাচ্যের অনুদানপ্রাপ্ত রাবেতা আল ইসলাম হাসপাতালে পল্লী চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের নামে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রত্যেক হাসপাতালের পাশে রাবেতার নামে আসা অনুদানে মীর কাসেম আলী গড়ে তুলেছিলেন কওমি মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসায় রোহিঙ্গা যুবকদের পাশাপাশি শিবিরের তরুণ সদস্যরাও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত কক্সবাজারের মরিচ্যা, রাঙামাটির লংগদু এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মীর কাসেমের রাবেতা আল ইসলাম ও কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম ছিল। সেখানে প্রশিক্ষণ পাওয়া যুবকরা যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে সহিংস নাশকতায় অংশ নিয়েছিল বলেও আমাদের কাছে তথ্য আছে। তবে এখন আগের সেই অবস্থান নেই। তাদের নেটওয়ার্ক আমরা ভেঙে দিয়েছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে রাঙামাটির লংগদু ও কক্সবাজারের মরিচ্যা এলাকায় দুটি রাবেতা আল ইসলাম হাসপাতাল গড়ে তোলেন মীর কাসেম আলী। দুটি মাদ্রাসার পাশে দুটি বড় কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮০ সালে কক্সবাজারে রাবেতা আল আলম ইসলামী হাসপাতালে জামায়াতের মদদে মীর কাসেমের সহায়তায় বিচ্ছিন্নতাবাদী রোহিঙ্গা তরুণ-যুবকদের নিয়ে আরএসও সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা করা হয়। ড. মোঃ ইউনুচ রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) নামে প্রথমে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর পরামর্শে এ সংগঠনটি আরএসও নাম ধারণ করে। নিজেদের কৌশলপত্র নির্ধারণ, মানচিত্র, পতাকা তৈরিসহ নিজস্ব সংবিধানও রয়েছে আরএসও জঙ্গিদের। ২০১২ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে ‍জানা যায়, আরএসও ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন আল কায়েদার সঙ্গেও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। আরএসও’র অনেক সদস্য আল কায়েদার হয়ে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

সূত্রমতে, মীর কাসেম আলীর তত্তাবধানে কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার পাহাড় ও সমুদ্র চরাঞ্চল এলাকায় আরএসও গড়ে তুলে ১০টি মাদ্রাসা-এতিমখানা ও রোহিঙ্গা বস্তি। এসব স্থাপনা তৈরি করতে আরএসও ক্যাডাররা অবৈধ দখলে নেয় অন্তত দু’শ একর বন বিভাগের জমি। এর নেপথ্য অর্থ যোগানদাতা মীর কাসেম আলীর রাবেতা এনজিও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশি ও নব্বইয়ের দশকজুড়ে মীর কাসেম আলী নিজেই কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটির গহীন অরণ্যে গিয়ে রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী নামধারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতেন। রাবেতা আল ইসলামের মাধ্যমে পল্লী চিকিৎসক প্রশিক্ষণের আড়ালে তখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা তরুণ-যুবককে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে এনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা তরুণ-যুবকদের সামনে স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। আর সেগুলো প্রচার করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে কোটি কোটি ডলার অনুদান আনতেন। সেই অনুদানের একটি বড় অংশ যেত নিজের ও জামায়াতের তহবিলে। এভাবেই ধনকুবেরে পরিণত হন মীর কাসেম।

সূত্রমতে, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের বিচার শুরুর পর সেটা বানচালে মীর কাসেম আলী প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা যুবকদের কাজে লাগানো শুরু করেন। আফগান ও পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার আয়ুব, আবু ছালেহ, থোয়াইঙ্গাকাটার আরএসও জঙ্গি মওলানা আনিস, রোমালিয়ারছড়ায় বসবাসকারী মৌলভী শফিক, টেকপাড়ার ইসমাইল, আবু আবদুল্লাহ, মৌলভী আবদুর রহমান, মাস্টার এনাম, আবু সিদ্দিক, রামুতে বসবাসকারী মৌলভী মোয়াজ্জেম হোছাইন ও হাফেজ নায়েমসহ বহু রোহিঙ্গা জঙ্গি জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মিলে গোপন নাশকতায় অংশ নিয়েছে বলে তথ্য ছিল পুলিশের কাছে।

ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় সহিংসতা যেভাবে জঙ্গি রূপ নিয়েছিল সেটার তদন্ত করতে গিয়ে আমরা রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার তথ্য পাই। এরপর সরকারীভাবে রাবেতার কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। আমরাও রাবেতা এবং কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নজরদারির আওতায় আনি। মূলত এরপর থেকেই আরএসও জঙ্গিদের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে এসেছে। জামায়াতের প্রভাবও নেই।

No comments:

Post a Comment