Saturday, December 19, 2015

“আমি সিগারেট বলছি” ডাঃ ফারহানা মোবিন


ডাঃ ফারহানা মোবিন::  আমার নাম সিগারেট। বিড়ি নামেও আমি পরিচিত। আমি সাদা কাগজে মোড়ানো। দেখতে কলমের মতো একটি মাদকদ্রব্য। আমাকে দেখতে শান্তির প্রতীকের মতো মনে হয়। কারণ আমি দেখতে সাদা। কিন্তু আমি ভীষণ ভয়ানক একটি মাদকদ্রব্য। আমি খুব সহজলভ্য একটি মাদক। আমি পৃথিবীর সব দেশে, শহরে এবং গ্রামেও পাওয়া যায়।

যে কোন দেশের মানুষের মধ্যে আমি খুব দ্রুত নেশা তৈরী করতে পারি। ছোট, বড় নারী, পুরুষ যে কেউ আমার নেশাতে আক্রান্ত হয়। দুই থেকে তিন দিন কয়েকবার আমাকে গ্রহণ করলেই, আমি নেশাতে পরিণত হই। যে কোন দেশের, যে কোন পরিবেশের মানুষকে আমি দ্রুত আসক্ত করে ফেলি। আমার অপর নাম ‘ধূমপান’।

আমার দেহের ক্ষতিকর পদার্থগুলো রক্তে মিশে নেশা তৈরী করে। রক্তে মিশে যাবার পরে মস্তিষ্কের ¯œায়ুগুলো বার বার ধূমপান করার জন্য মনুষকে বাধ্য করে। পরিণামে তীব্র নেশাতে পরিণত হয়। তখন ধূমপান হয়ে যায় জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সদস্য।

সিগারেটের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থটির নাম হলো ‘নিকোটিন’। নিকোটিন দেহের রক্তের সাথে মিশে পুরো দেহের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপকে পরিবর্তন করে দেয়। তখন দেহ বার বার নিকোটিন কেই চায়। মানুষ না চাইলেও তখন নেশা হয়ে যায়। সিগারেট খাওয়া মানে ধূমপান। আর ধূমপান মানেই বিষপান। সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছে নানান রকমের সুন্দর সুন্দর প্যাকেটে আর বাক্সে ভরা সিগারেট। নামীদামী কোম্পানিরও রয়েছে প্রচূর সিগারেট। কিন্তু যতো বড়ো কোম্পানিরই হোক না কেন সিগারেট বা ধূমপান হলো বিষপান।

এই বিষপান দেহে তৈরী করে নিকোটিনের প্রতি নির্ভরতা। যা চাইলেও ছাড়া যায় না। মাত্র ৪-৫ দিন নিয়মিত খেলেই নেশা হয়ে যায়। তখন সিগারেট না খেলে ভালো লাগে না। মাথা জ্যাম হয়ে আসে। মাথা ঠিক মতো কাজ করছেনা। এই ধরণের অনুভূতি হয়।

অর্থাৎ সিগারেটের নিকোটিন দেহের মধ্যে এমনভাবে বাসা বেধে ফেলে যে, তখন নিকোটিন ছাড়া ভালো লাগেনা। দূর্বল লাগে, অস্বস্তি আর বিরক্তিতে মাথা ঘুরায়। অনেকের ভয়ঙ্কর মাথা ব্যাথা শুরু হয়। যারা উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাদের রক্তচাপ পর্যন্ত বেড়ে যায় বিরক্তি আর অস্বস্তির কারণে। ছোট্ট একটি জিনিস কিন্তু দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একটি সিগারেট দেহের একবিন্দু রক্ত নষ্ট করে ফেলে। দেহের রক্তের মূল উপাদান হলো লোহিত রক্ত কণিকা। একটি সিগারট একটি লোহিত রক্ত কণিকাকে দূর্বল করে দেয়।

লোহিত রক্ত কণিকা দূর্বল হয়ে পড়লে মানুষও দূর্বল হয়ে যায়। তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে। ফলে দেহে বাসা বাথে নানান রকমের অসুখ।

আমি ‘সিগারেট’ বলছি, তোমরা আমাকে ঘৃণা করো। আমার কোন ভালো দিক নায়। আমি শুধু তোমাদের ক্ষতিই করি। আমার উপকারী কোন গুণ নায়। এই পৃথিবীতে শুধু সিগারেট না, প্রতিটি মাদক দ্রব্যই হলো স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ খারাপ। মাদক দ্রব্য দেহের প্রতিটি অঙ্গের উপর ফেলে বিরূপ প্রভাব। ঘুনে ধরা পোঁকার মতো মানুষকে দূর্বল করে দেয়। মৃত্যু এসে দ্রুত নিয়ে যায় না ফেরার দেশে।

আমি ‘সিগারেট’ বলছি। তোমরা আমাকে ঘৃণা করো। যারা আমাকে গ্রহণ করেছে, আমি শুধু তাদের না, যারা আমাকে গ্রহণ করেনি আমি তাদেরও ক্ষতি করি। যদি একটি বাসায় একজন ধূমপান করে, তবে অন্য যারা ধূমপান করেনা তাদেরকেও হুমকির মুখে ফেলে দেয় ধূমপান।

ধূমপান বলতে বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, তামাক সব কিছুকেই বোঝায়। যে কোন প্রকারের ধূমপানই হলো বিষপান। গর্ভস্থ শিশুর জন্যও ধূমপান ভীষণ খারাপ। যেসব মা বাবা ধূমপান করেন, তাদের সন্তানেরা হয় নানান রকম রোগের শিকার। অন্য শিশুদের তুলনায় তারা হয় দূর্বল ও কম মেধা সম্পন্ন। জীবন যুদ্ধে তারা পিছিয়ে পড়ে। কোন বাসায় একজন ধূমপান করলে ধূমপানের সময় নির্গত হওয়া বিষাক্ত গ্যাসের জন্য বাসার অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গর্ভবতী মায়ের শিশুরাও হয় বিভিন্ন অসুখের শিকার।

মায়ের পেটে থাকলেও তারা আক্রান্ত হয় বিভিন্ন জটিলতায়। যেমনÑ নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই তাদের জন্ম হতে পারে, যাদেরকে বলে প্রিমেটিউর (চৎবসধঃঁৎব) বেবি। অনেকের শ্বাসকষ্টও হয় জন্মের পূর্বে (পেটের মধ্যে) ও পরে (জন্মের সময় বা পরে)।

ধূমপানের সময় নির্গত হওয়া বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে মিশে পুরো পরিবেশকে করে তোলে বিষাক্ত। যা ছোট বড় সবার জন্য ক্ষতিকর। সিগারেট পুরো দেহের সব অঙ্গকে বৃদ্ধ করে তোলে। ত্বকে আনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। দেহের সবগুলো অঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ করে ফুসফুসকে। (ফুসফুস বুকের মধ্যে অবস্থিত দেহের একটি জরুরী অঙ্গ; যার মাধ্যমে আমরা নিঃশ্বাস নিই)।

দীর্ঘবছর প্রচুর পরিমাণে সিগারেট খেলে শ্বাসকষ্ট থেকে যক্ষ্মা, ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। যারা ধূমপান করে তারা এ্যাকটিভ (অপঃরাব) স্মোকার (ঝসড়শবৎ) আর যারা ধূমপায়ীর পাশে থাক বা ধোয়া ধূমপায়ীর আশে পাশে যাদের মধ্যে পৌছে তারা হলে প্যাসিভ স্মোকার (চধংংরাব ঝসড়শবৎ)।

এ্যাকটিভ আর প্যাসিভ স্মোকার দুজনেই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই বিরত থাকুন ধূমপান সহ সব ধরণের মাদক থেকে।

ধূমপান, কারখানার বিষাক্ত ধোয়া, পরিবেশ দূষণে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে কার্বন মনো অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন সব যাবতীয় ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমরা বিভিন্ন শারীরিক মানসিক জটিলতার শিকার হচ্ছি। যা কখনোই কাম্য নয়।

আসুন আমাদের দেহ, মন, পরিবেশকে আমরা ভালো রাখি। ধূমপান সহ যাবতীয় মাদককে ‘না’ বলি। শুধু এই দেশ নয়, পুরো পৃথিবীকে ভালো রাখার জন্য আমরা ধূমপানকে ঘৃণা করি। তাই আমি ‘সিগারেট’ তোমাদের আবারো বলছিÑ “তোমরা আমাকে ঘৃণা করো”।

ডাঃ ফারহানা মোবিন
এমবিবিএস (ডি.ইউ), এমপিএইচ (ইপিডেমিওলজি-থিসিস পার্ট),
পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ট্রেনিং ইন গাইনী এন্ড অবস্ (স্কয়ার হাসপাতাল),
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (গাইনী এন্ড অবস্),
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment